একজন মানুষ, যিনি নিজের অস্তিত্বকে পেছনে ঠেলে সামনে তুলে ধরেন সন্তানের স্বপ্নকে—তাঁকেই আমরা “বাবা” বলে চিনি। এই একটি শব্দে জড়িয়ে থাকে যে নির্ভরতা, যে আশ্রয়, যে নিরব ভালোবাসা—তা কোনো অভিধানে সংজ্ঞায়িত হয় না, কেবল হৃদয়ের গভীরতম অনুভবে তা অনুভূত হয়।
আমার বাবাকে আমি চোখ খুলেই দেখি না। আমি যখন মায়ের গর্ভে, তিনি তখন হাজার মাইল দূরে, অজানা এক ভিনদেশে, জীবনের এক অন্যরকম জিহাদে লিপ্ত। তিনি দেশ ছাড়েন বিলাসের লোভে নয়, কোনো অলস স্বপ্নের মোহে নয়—বরং অদেখা এক সন্তানের ভবিষ্যৎ নির্মাণে আত্মনিয়োগের এক নিঃশব্দ শপথ নিয়ে। আমি যখন এই পৃথিবীর আলো দেখি, তখন তিনি দূরদেশে রক্ত আর ঘামে আমাদের সুখের ভিত্তি গড়ে তুলছেন।
আমার বাবাকে আমি প্রথম দেখি সাত বছর বয়সে। সেই মুহূর্তটি যেন এখনো আমার হৃদয়ের অলিন্দে জমা—স্মৃতির মতো নয়, যেন তা এখনো স্পন্দিত আমার রক্তের প্রতিটি প্রবাহে। কোনো নাটকীয় পুনর্মিলন নয়, বরং এক গভীর আত্মিক স্বীকৃতি—এই মানুষটি, যাঁর মুখ আমি চিনি না, অথচ যিনি আমাকে ছায়ার মতো আগলে রেখেছেন জন্মলগ্ন থেকে; তিনি-ই আমার বাবা।
তিনি যে ভালোবাসেন, তা মুখে বলেননি কখনো। কিন্তু আমি তা বুঝেছি আমাদের থালাভরা আহারে, মাথার উপর ছাদের নিশ্চয়তায়, শিক্ষার প্রতিটি ধাপে তাঁর অদৃশ্য সমর্থনে। তিনি ছিলেন এক নিঃশব্দ প্রহরী, যিনি রাত জেগে আমার ঘুমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন, দিনের আলোয় ঘাম ঝরিয়ে আমার জীবনের ভিত গড়েছেন।
আমার বাবা নিজের জন্য কিছুই রাখেননি। বছরের পর বছর একই জামা পরে থেকেছেন, নিজের খাওয়া-চলা সীমিত করে আমাদের প্রয়োজন মিটিয়েছেন। তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল—আমরা যেন বড় হই, মানুষ হই, আলোর পথে হাঁটি।
আমি সৌভাগ্যবান—আমার বাবা আমাকে এমন এক শিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যার ভিত্তি শুধু নয় প্রাতিষ্ঠানিক গৌরব নয়, বরং চারিত্রিক দৃঢ়তা। আমি পড়েছি দেশের খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান দারুননাজাত সিদ্দিকীয়া কামিল মাদ্রাসাতে। আর আজ, আল্লাহর অশেষ কৃপায়, আমি অধ্যয়ন করছি আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে, কায়রো, মিশর—যেখানে দাঁড়াতে আমার বাবার প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি ঘামের বিনিময় জড়িত।
তিনি শুধু একজন উপার্জনকারী নন। তিনি আমার জীবনের জীবন্ত আদর্শ, চলমান প্রার্থনা, একটি ছায়ার মতো আশীর্বাদ—যিনি সামনে থাকেন না, কিন্তু সর্বদা পাশে থাকেন। পিতৃত্বকে তিনি কেবল দায়িত্ব হিসেবে দেখেননি, দেখেছেন একটি অবিচল আমানত হিসেবে।
আজ বাবা দিবসে আমার হাতে কোনো দামি উপহার নেই। আছে শুধু এক নিবেদিত কৃতজ্ঞতা, কলমভরা ভালোবাসা, এবং আল্লাহর দরবারে একান্ত দোয়া—
হে দয়াময়, আমার বাবাকে সুস্থ রাখুন, নেক হায়াত দান করুন। তাঁর ছায়া যেন আমার জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে বয়ে চলে শান্তির বাতাস হয়ে।
লেখক ও কলামিস্ট, শিক্ষার্থী—আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।