চা শুধু একটি পানীয় নয়, এটি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। হাজার বছরের পুরনো এই পানীয় আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এক কাপ চা কত গল্পের জন্ম দিতে পারে? হয়তো আমরা ভাবিও না, এই চায়ের পেছনে আছে হাজার বছরের ইতিহাস, সভ্যতার বাঁকে বাঁকে ছড়ানো বিস্ময়কর সব ঘটনা।
চা মূলত চীন থেকে এসেছে। চা নিয়ে প্রচলিত একটি পৌরাণিক গল্প মতে, খ্রিষ্টপূর্ব আনুমানিক ২৭৩৭ সালের দিকের কথা, চীনা সম্রাট শেননং ঔষধি গাছের খোঁজে বনের জানা-অজানা গাছের বাকল আর পাতা চিবিয়ে স্বাদ নিচ্ছিলেন। একসময় তিনি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন।
এ সময় বাতাসে ভেসে একটি পাতা তাঁর মুখে পড়ে। সেই পাতা চিবিয়ে দ্রুতই সুস্থ হয়ে ওঠেন রাজা। সে পাতাটিই ছিল নাকি চা-পাতা! পরবর্তীতে জনপ্রিয়তা অর্জন করে তাং রাজবংশের সময়। এ সময় চা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
এবার পাড়ি জমায় জাপানে। বৌদ্ধ ভিক্ষু আইচো চীন থেকে বীজ নিয়ে যান এবং সেখানে গড়ে ওঠে এক শিল্পনির্ভর চা সংস্কৃতি—‘চা চানোইউ’, যা ধ্যান ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে মিশে এক অনন্য রূপ নেয়।
ইউরোপে ১৭০০ শতকে ডাচ বণিকদের হাত ধরে চা পৌঁছায়। লন্ডনে ১৬৫৭ সালে প্রথম চা বিক্রি হয়। পরে ব্রিটিশ সমাজে এটি হয়ে ওঠে দৈনন্দিন জীবনের অংশ। আর অ্যামেরিকার ১৭৭৩ সালে “বেস্টন টি পার্টি” চায়ের করকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাপ। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের প্রবেশ গল্পটা ভিন্ন।
১৮২৩ সালে আসামের সিঙ্গলিতে রবার্ট ব্রুস প্রথম খুঁজে পান স্থানীয়ভাবে জন্মানো চা উদ্ভিদ। এই আবিষ্কার ছিল ইতিহাসঘন। ব্রিটিশরা দ্রুত বুঝে যায়, চীননির্ভরতা কমিয়ে চা উৎপাদনে ভারত হতে পারে তাদের প্রধান ঘাঁটি। ১৮৩৯ সালে গড়ে ওঠে ‘আসাম কোম্পানি’। পাহাড়ি অঞ্চলের আদর্শ আবহাওয়া কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশরা একের পর এক চা-বাগান স্থাপন করে—আসাম, দার্জিলিং, ডুয়ার্স থেকে সিলেট পর্যন্ত। মালনীছড়ায় ১৮৫৪ সালে শুরু হয় উপমহাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা উৎপাদন। রেললাইন তৈরি, চা-শ্রমিক নিয়োগ ও করছাড়—সবই ছিল এই শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক বৃহৎ ঔপনিবেশিক পরিকল্পনার অংশ।

সিলেটের মালনীছড়া-বাংলাদেশের প্রথম চা–বাগান। ছবি – সংগৃহীত।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন ১৬৭টি বাগানে চা উৎপাদিত হচ্ছে। পাহাড় ছেড়ে সমতলেও নেমে আসছে চা বাগান। দেশের বড় বড় শিল্প গ্রুপগুলো চা বাগানের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে চা এখন কেবল শৌখিন পানীয় নয়, নিত্যদিনের নেশায় পরিণত হয়েছে। লাল চা থেকে শুরু করে দুধ, লেবু, তেতুল, মাল্টা, মালাই বা মটকা হরের স্বাদের চা মিলছে দেশের সর্বত্র।

পাইকারি ও খুচরা চায়ের দোকান। ছবি-মালিহা জান্নাত মিশা
খুলনা বড়বাজারের পাইকারি বিক্রেতা মন্টু লস্কর জানান, দেশে এখন বিভিন্ন মানে চায়ের চাহিদা রয়েছে। সিলেট পঞ্চগড় সহ বিভিন্ন অঞ্চলের চা আসে ঢাকায় আমরা মূলত ঢাকা থেকে চা পাইকারি ভাবে এনে বিক্রয় করি। মানুষ নতুন ধরনের চায়ের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে, যেমন ক্লোন চা, দানা চা, গুড়া চা – এগুলো বেশি বিক্রয় হয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের তপন নামের একজন খুচরা চা বিক্রেতা বলেন, এখানে তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে চা বিক্রি করেন। আগে সাধারণত লাল চা খেতো, এখন দুধ চা, আদা চা, লেবু চা অনেক ধরন চলত। ছাত্ররা নিয়মিত আসে চা খায়, আড্ডা দেয়।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের ছাত্র সামিউল ইসলাম বলেন, “চায়ের দোকানই আমাদের ‘চিলিং স্পট’। আড্ডা, বিতর্ক, কবিতা—সবই শুরু হয় এক কাপ চা দিয়ে। আমার কাছে চা মানে বন্ধুত্ব।“